ষোল শতকের শেষের দিকে ইংরেজদের আবিষ্কৃত একটি খেলা ক্রিকেট। অন্যান্য খেলার বিভিন্ন নিয়ম-কানুন থাকলেও ক্রিকেটের বেলায় এর নিয়ম গুলো যেন এক একটি আইন। এই লাইনগুলোর বেশিরভাগই লেখা হয়েছিল উনিশ শতকে লন্ডনের লডস নামক খেলার মাঠে। তাই লডসকে বলা হয় হোম অফ ক্রিকেট। সেই ক্রিকেট আর বর্তমানকালের ক্রিকেটের মধ্যে অনেক পার্থক্য, ক্রিকেট যেন এখন টাকার খেলা, সেই সাথে যোগ হয়েছে গ্ল্যামার। বদলে যাওয়া এই ক্রিকেট খেলায় একটি জিনিস এখনো পাল্টায়নি তা হল এর জটিলতা। তারপরও এই জটিল খেলাটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দারুণ জনপ্রিয়। ২০১৫ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত বনাম পাকিস্তানের ম্যাচ টি বিশ্বব্যাপি প্রায় ১০০ কোটি মানুষ সরাসরি দেখেছে যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার সাত ভাগের একভাগ।
আঠারো ও উনিশ শতকের মধ্যে ইংরেজরা তাদের উপনিবেশগুলোতে ক্রিকেট খেলার প্রচলন করে। সেসময় আমেরিকানরাও কিছুদিন ক্রিকেট খেলেছিল। ক্রিকেটকে একটি উপনিবেশিক খেলা আখ্যা দিয়ে পরবর্তীতে আমেরিকানরা এ খেলা পরিহার করে কিন্তু অন্যান্য উপনিবেশগুলো ক্রিকেটকে তাদের শাসকদের পরাজিত করার একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। ইংরেজরা তাদের উপনিবেশ দেশগুলো থেকে খেলোয়াড়দের ইংল্যান্ডে আমন্ত্রণ জানাতো। তখনকার দিনে শুধু দীর্ঘমেয়াদী টেস্ট ম্যাচ খেলার প্রচলন ছিল। এরপর ইংরেজদের উপনিবেশ অবসানের বহু বছর পর ১৯৭৫ সালে ক্রিকেটে আসে বিশ্বকাপ । সেই বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ওডিআই বা ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ বা একদিনের ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে পার পর প্রথম দুইটি
বিশ্বকাপ জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই মহাযগ্যের তৃতীয় আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ঘরেতোলে ভারত। তার চার বছর পর প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বাইরে ভারতে চতুর্থ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন করা হয়। সেই থেকে ক্রিকেট ভারতের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির একটি বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ক্রিকেট খেলার আবিষ্কারক ইংল্যান্ড ক্রিকেটে বিশ্বকাপ অর্জন করতে পারেনি। ক্রিকেট খেলায় প্রতিটি দলে এগারোজন খেলোয়াড় অংশ গ্রহণ করেন। খেলা শুরু হয় টস এর মাধ্যমে। টসে জয়ী দল সিদ্ধান্ত নেয় তারা আগের ফিল্ডিং করবে নাকি ব্যাটিং। ব্যাটিং দলের দুজন খেলোয়াড় ২২ গজের দুই প্রান্তে অবস্থান করে। তাদের লক্ষ্য রান সংগ্রহ করা। অপরদিকে ফিল্ডিং দল সকল উপায়ে তাদের আউট করার চেষ্টা করে। পিচের দুই প্রান্তে থাকে তিনটি উইকেট। উইকেট মূলত তিনটি কাঠের খন্ড বা স্ট্যাম্প
দ্বারা গঠিত। এই স্ট্যাম্প তিনটির মাথায় আরও দুই টুকরো কাঠ বা বেল থাকে।
একজন ব্যাটসম্যান উইকেট এর সামনে দাঁড়িয়ে বোলারের ছুরে দেয়া বল
ব্যাট দিয়ে আঘাত করে রান সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। একবার প্রান্ত বদল করতে পারলে হয় এক রান।ব্যাটসম্যানেরা যখন
রান সংগ্রহ করার জন্য দৌড়ায় ফিল্ডিং দলের সদস্যরা বল কুরিয়ে ব্যাটসম্যানের পৌঁছে যাবার আগেই যেকোনো একটি উইকেট ভাঙ্গার চেষ্টা করে। ব্যাটসম্যান উইকেট ভাঙ্গার আগে পৌছাতে না পারলে সে আউট হয়ে যায় এবং নতুন ব্যাটসম্যান আসে। এছাড়া একজন বোলার বলছুরে সরাসরি উইকেট স্পর্শ করতে পারলেও ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যায়। আর ব্যাটসম্যান যদি জোরালোভাবে বলে আঘাত করতে সক্ষম হয় তাহলে রান সংগ্রহের জন্য দৌড়ানোর দরকার পড়ে না। বল মাঠের সীমানায় পৌঁছে গেলে চার রান সংগ্রহীত হয় আর বল উড়ে গিয়ে সীমানার বাইরে পড়লে ছক্কা অর্থাৎ ৬ রান। ছক্কা মারতে গিয়ে ব্যাটসম্যান বল শূন্যে ভাসিয়ে দেয়ার পর যদি কোন ফিল্ডার সেটি তালুবন্দী করতে পারে তাহলে ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যায়। আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন খেলওয়ার নিয়মিত ব্যাটিং করে যেতে পারে। তবে একজন বোলার একনাগাড়ে মাত্র ৬টি বল ছুটতে পারে। ৬ বলের এই চক্রকে বলা হয় ওভার। প্রতি ওভার শেষে দলের অন্য একজন খেলোয়াড় বোলিং এর দায়িত্ব নেন। যখন ব্যাটিং দলের ১১ জন খেলোয়াড়ের ১০ জনই আউট হয়ে যায় তখন এক ইনিংস ঘোষিত হয় এবং ফিল্ডিং দল তারপর ব্যাটিং করতে নামে।
ঐতিহ্যগতভাবে টেস্ট ক্রিকেটে একটি দল দুইটি ইনিংস খেলার সুযোগ পায় । দুইটি ইনিংসের সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহকারী দল জিতে যায় এবং ৫ দিন পরও যদি খেলা শেষ না হয় তাহলে আম্পায়ার ম্যাচটি ড্র ঘোষণা করেন। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ গুলো সাধারণত কোন ফলাফলের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হয়। তবে সিরিজ নির্ধারণী কোন ম্যাচ না হলে সাধারণত এখানেও টাই ম্যাচ দেখা যায়।
একবিংশ শতাব্দীতে হঠাৎ করেই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। ২০০০ সালের শুরুতেই একটি ব্রিটিশ টিভি নেটওয়ার্ক কোম্পানি এই সমস্যার কারণ খুঁজতে স্টুয়ার্ড রবাটসনকে গবেষণার দায়িত্ব দেন। গবেষণায় দেখা যায় ক্রিকেট খেলা দীর্ঘক্ষণ যাবৎ চলার কারণে দর্শকেরা মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। তখন রবাটসন স্বল্প দৈর্ঘের একটি ফরম্যাটের পরিকল্পনা করেন। যে ম্যাচে প্রতি দল মাত্র ২০ ওভার খেলার সুযোগ পাবে আর সময়সীমা হবে অনুর্ধ তিন ঘন্টা। রবার্টসনের এই প্রস্তাবনা ব্যাপক জনপ্রিয়তা
পায়। ক্রিকেটের এই নতুন সংস্করণের নাম হয় টুয়েন্টি-টুয়েন্টি বা সংক্ষেপে টি-টোয়েন্টি । হোম অফ ক্রিকেট লডসে টুয়েন্টি-টুয়েন্টির প্রথম পরীক্ষামূলক ম্যাচটি খেলা হয়। এরপর ২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে ইডেন পার্কে ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে। ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ আয়োজন করা হয় সাউথ আফ্রিকায় । ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারত প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হয়।
২০০৮ সালে টি-টোয়েন্টিতে নতুন মাত্রা যোগ করে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল। ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক এই টুর্নামেন্টে বলিউড তারকা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কোম্পানি ও ধনকুবেরদের বিনিয়োগে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টেলিভিশনের এক জনপ্রিয় বিনোদন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। ক্রিকেটকে একটি লাভজনক বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করার পেছনে টি-টোয়েন্টির অবদান সবচেয়ে বেশি।
ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বর্তমানে শক্তিশালী একটি দল। ১৯৭৬ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্য হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম তার আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচটি খেলে। এরপর ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট স্ট্যাটাস খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। প্রায়
এক দশকধরে অনানুষ্ঠানিকভাবে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পর ২০০১ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়। এরপর সময়ের সাথে ধীরে
ধীরে বাংলাদেশ ক্রিকেট পরিণত হয়েছে এবং বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ্
একটি পরাক্রমশালী দল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন