Development Worker

test

Post Top Ad

Your Ad Spot

শনিবার, ২ অক্টোবর, ২০২১

এটমবোমা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ




দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর তৎকালীন দুই বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ  এবং ওপেনহাইমার এর মধ্যে চলছিল আরেক অদৃশ্য ‍যুদ্ধ । সে সময়   জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে খুঁজতে থাকে এটমবোমা বা পারমাণবিক বোমা তৈরীর কৌশল। আমেরিকানরা তখন খুব  আতঙ্কিত ছিল এই ভেবে যে জার্মানরা হয়তো যেকোনো মুহূর্তে পারমানবিক বোমা আবিষ্কার করে ফেলতে পারে।  কারণ হাইজেনবার্গের নেতৃত্বে জার্মানরা অনেক আগেই সে কাজ শুরু করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে আমেরিকানরাই প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করে পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাস বদলে দেয়।

 

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির তরুণ বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ পদার্থবিজ্ঞানের নতুন শাখা কোয়ান্টাম  ফিজিক্স নিয়ে কাজ শুরু করেন। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা হচ্ছে বন্তুর সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক পরমাণুর পদার্থবিদ্যা। ১৯২৫ সালে হাইজেনবার্গ একটি পরমাণুর ভেতরকার ক্ষুদ্রকণা ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রনের  আচরণ সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। অতি পারমাণবিক অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করা এর তত্ত্ব হাইজেন বার্গের অনিশ্চয়তাবাদ নামে পরিচিত। ১৯৩২ সালে মাত্র একত্রিশ(৩১)  বছর বয়সে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিশেষ অবদানের জন্য হাইজেনবার্গ  পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।  ঠিক একই সময়ে জার্মানির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আবির্ভূত হচ্ছিল এক নতুন শক্তি দ্যা ইন্টারন্যাশনাল সোস্যালিস্ট পার্টি বা নাতসি বাহিনী।

 

অন্যদিকে হাইজেনবার্গের গবেষণা জার্মানি থেকে ৫ হাজার মাইল দূরে আমেরিকান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ওপেনহাইমারকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৩৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানীদের একটি দল ইউরেনিয়ামের একটি পরমাণুকে বিভক্ত করে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দিতে সমর্থ হয়। নতুন ধরনের এই পারমাণবিক বিক্রিয়ায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার চেয়ে ৫ কোটি  গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হয়। ততদিন পর্যন্ত পারমাণবিক বোমার একটি তাত্ত্বিক বিষয় থাকলেও এই পরীক্ষার পরে হাইজেনবার্গ এবং ওপেনহাইমার দুজনেই বুঝতে পারেন পারমাণবিক বোমা খুব শিঘ্রই বাস্তবে রূপ নিতেলেছে । ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে হাইজেনবার্গ রেডিও একটিভ মৌল থেকে প্রাপ্ত অচিন্তনীয় শক্তি কাজে লাগিয়ে এটমবোমা তৈরির প্রস্তাব দেন নাতসি বাহিনী কে। সে সময় ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকলে হিটলার পোল্যান্ড দখল করে নেয়। তখন ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডজার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নাতসিরা তখন চাচ্ছিল অতি দ্রুত ইউরোপের অন্যান্য অংশ দখল করে নিতে এবং সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চলতে থাকে ভয়ঙ্কর এটমবোমা তৈরীর কাজ। নাতসিরা তাদের যুদ্ধের জন্য এটমবোমকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভবনাময় মনে করে। হাইজেনবার্গও তাদের প্রত্যাশা পূরণের উদ্দেশ্যে জার্মানির লিকলিকে অবস্থিত তার পরীক্ষাগারে নিরলস কাজ করে যান।



                          

                                                                        হাইজেনবার্গ  


অন্যদিকে আমেরিকাতে পারমাণবিক রহস্য উন্মোচনের কাজ বলতে গেলে তখন শুরুই হয়নি। ঠিক এমন সময়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ আলবার্ট আনেষ্টাইন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কে চিঠি লিখে জানান- জার্মানরা এক সুপার ওয়েপেন  তৈরি করছে যা নিমিশেই একটি শহরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।  আইনস্টাইনের সেই ইতিহাস বদলকারী চিঠি রুজভেল্ট অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেন। সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় আমেরিকানদের পাল্টা গবেষণা। ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হয় আমেরিকার সর্বকালের সবচেয়ে গোপন প্রকল্প প্রজেক্ট ম্যানহাটান।  তৎকালীন সময়ে আমেরিকাতে পারমানবিক বোমা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা ছিল ওপেনহাইমারের। তাই ওপেনহাইমারকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রকল্পের পরিচালক বানানো হয়। 

 

অন্যদিকে জার্মানীতে হাইজেনবার্গও একই কাজে ওপেনহামারের থেকে এক বছর এগিয়ে ছিলেন। ১৯৪১ সালের আগে একটি মাত্র পরমাণু ভাঙ্গন সম্ভব হলেও একসাথে লক্ষ লক্ষ পরমাণুর ভাঙ্গন তখনও সম্ভব হয়নি। এক সাথে ভাঙ্গা সম্ভব হলে গাণিতিক চক্রবৃদ্ধি হারে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে সেটি দিয়েই তৈরি হবে এটমবোমা।  ১৯৪৩ সালের মার্চে আমেরিকার নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের লসআলামাস শহরে তৎকালীন সময়ের সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে ওপেনহাইমার তার কাজ শুরু করেন। অন্যদিকে পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে হাইজেনবার্গ তার সহকর্মীরা কোনমতে প্রাণ বাঁচিয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন। তাদের সমস্ত কাজ ও অগ্রগতি সহ লিউজিকের সেই ল্যাবরোটরি একদম ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। এই খবর পেয়ে আমেরিকারা ধরেই নেয় যে জার্মানরা নিশ্চয় এটমবোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে।  হাইজেনবার্গের ল্যাবরোটরি বিস্ফোরণের ঘটনাকে জার্মানির সাফল্য ভেবে ভুল করা খবরটাই আমেরিকানদের সর্বদা তাগিদ দিচ্ছিল। অন্যদিকে  ল্যাবরোটরি গবেষণার সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত হবার পর হাইজেনবার্গ প্রচণ্ড মানসিক চাপে ছিলেন। নাতসিরা তাকে জানিয়ে দেয় এতদিনের এই প্রকল্পের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। ১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে জার্মানির দুর্দশা চরমে পৌঁছায়। বার্লিনে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ এবং সোভিয়েত বাহিনী জার্মানির সীমানায় চলে আসায় নাতসি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে।  



রবার্ট ওপেনহেইমার


১৯৪৫ সালের মে মাসেরতারিখে হাইজেনবার্গ সহ জার্মানির শীর্ষ বিজ্ঞানীরা মিত্র বাহিনীর হাতে আটক হন। তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সেরা পদার্থবিদ হওয়ার কারণে হাইজেনবার্গকে কড়া নজরদারির মধ্যে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অপরদিকে সবরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ওপেনহাইমার সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌছেযান। ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই তারা তৈরি করেন তিনটি পারমানবিক বোমা।

 

 একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ নিউক্লিয়ার ফিউশন টাইপ, যার সাংকেতিক নাম লিটলবয় এবং অপর দুইটি প্লুটনিয়াম বেইজড ইনফ্লোয়েশন  এটমবোমা যার একটির নাম গ্যাজেট অপরটির নাম ফ্যাট ম্যান। এবার তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর দুই বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে তৈরি এটম বোমার ক্ষমতা পরীক্ষার পালা।  ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বোমার সেই পরীক্ষা ট্রিনিটি টেস্ট নামে পরিচিত। ট্রিনিটি টেস্টের বোমাটি  এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, এর বিস্ফোরণস্থলের তাপমাত্রা সূর্য পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার গুণ বেশি ছিল। এর তীব্রতা ছিল ২০ হাজার টন টিএন্ডটি বিস্ফরকের সমতুল্য  আর এর মাধ্যমে ওপেনহাইমার তৈরি করে ফেলেন মানব ইতিহাসের সবচাইতে শক্তিশালী মারণাস্ত্র। ট্রিনিটি টেস্টেরসপ্তাহ পর আগস্টের তারিখ একটি আমেরিকান প্লেন অবশিষ্ট দুটি পারমাণবিক বোমা নিয়ে উড়ে যায় জাপানের উদ্দেশ্যে । হিরোশিমা নাগাসাকিতে চালানো হয় মানব ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক আক্রমণ । বলা হয়  এর উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিটানা। আমেরিকার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ২০ হাজার  সৈন্যসহ ২ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন।

 

অসহ্য পারমানবিক বিকিরণেভুগে এর পরবর্তী চার মাসে মারা যায় আরও বহুলোক এটমবোমার পরস্পর বিরোধী একটি ব্যাপার হচ্ছে জাপানের দুই লক্ষাধিক নিরপরাধ মানুষ এতে মারা গেলেও রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোপুরি থেমে যায়। জাপানে পারমাণবিক হামলার পরেই আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে সূচিত হয় ধ্বংসযজ্ঞের শেষের শুরু।  হাইজেনবার্গ এবং ওপেনহাইমার দুজনেই এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী আবার একইসাথে চরম অমানবিক যুদ্ধ বন্ধ করার কান্ডারী হিসেবেও তারা সফল।

 


Post Top Ad

Your Ad Spot

Pages