চিত্র-১ নারী
সৃষ্টির আদিকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সৃষ্টির প্রকৃতির স্বতঃস্ফুর্ত নিয়মেই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি নিবৃত্ত করার জন্য পরস্পরের সংলগ্ন হয়ে পুরুষ ও নারীর অবস্থান।
কিন্তু এ অবস্থান সব
সমাজে সম পর্যায়ের নয়।
ভাষাহীন, পোশাকহীন উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘাসের উপর বসা দুজন নারী পুরুষ আর বর্তমান আধুনিক
সমাজে সজ্জিত ড্রইং রুমে আরামদায়ক সোফাসেটে পাশাপাশি বসা দুজন নারী পুরুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও মানসিক সহঅবস্থানে
অনেক পার্থক্য।
সৃষ্টির আদিযুগে খোলা আকাশের নীচে অবস্থানরত সমাজ থেকে বর্তমান সমাজ পর্যন্ত পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে অনেক জীবন সংগ্রামের ইতিহাস। এ সংগ্রামে নারী
ও পুরুষের সম্পর্ক কখনো সহযোদ্ধার, কখনো সাহেব ও বাদীর, কখনো
শোষক ও শোষিতের, কখনো
মালিক ও শ্রমিকের।
সমাজ বিজ্ঞানীরা সামাজিক পরিবর্তনের ঐতিহাসিক বিকাশকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আমরা ঐতিহাসিক বিকাশে বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর অবস্থানকে জানার জন্য সামাজিক পরিবর্তনের ইতিহাসকে ৪টি পর্যায়ে ভাগ করে নারীর অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করবো। (১) আদিম সাম্যবাদী
সমাজে নারী (২) দাস সমাজে
নারী (৩)
সামন্ত সমাজে নারী ও
(৪) পুঁজিবাদী সমাজে নারী।
(১) আদিম সাম্যবাদী
যুগে নারী
সামাজিক পরিবর্তনের ধারায় আদিম সমাজকে অনেকেই আদিম সাম্যবাদী সমাজ বলে অভিহিত করেছেন। নামকরণ থেকেই এ সমাজে নারী
পুরুষের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তখন মানুষ ফলমূল সংগ্রহ, পশু ও মৎস্য শিকার
করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তাদেরকে দলবদ্ধভাবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হতো। দলবদ্ধভাবে থাকার ভিত্তি ছিল রক্ত সম্পর্ক। তখন দলকত্রী ছিল স্ত্রী। আদিম সমাজে যে কোন পুরুষের
সঙ্গে স্ত্রী গর্ভে সন্তান ধারণ করতো বলে সন্তান মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতো। আদিম সমাজে স্ত্রী দ্বারায় উত্তরাধিকার নির্ণীত হতো। অনেকের মতে আদিম সাম্যবাদী সমাজে মালিকানা ছিল যৌথ, চাষাবাদে অর্থাৎ উৎপাদনে মেয়েরা ছিল বলে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল মেয়েদের হাতে। মাতৃপ্রধান সমাজে স্ত্রীলোক একাধিক পুরুষকে বিয়ে করত ও তার প্রভাব
পরিবারের উপর পড়তো। স্ত্রীলোকেরা যেমন ঘর-সংসারের কাজ
করতো , তেমনি আবার চাষের কাজও করতে। তবে সচরাচর তাদের উপর থাকতো সন্তান-সন্ততি পালনের দায়িত্ব। তবে মানুষের আদিম সমাজে মানুষে মানুষে বিভেদ ছিলনা এবং জমিকে ঘিরে সম্পত্তি চেতনাও ছিল না। সকলেই ছিল পরিশ্রমী এবং কেউ অন্যের শ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিলনা।
তখন সামাজিক শ্রম বিভাগ ছিল না এবং মাতৃ
প্রধান পরিবার সমাজ ব্যবস্থা হলেও পুরুষদের উপর মহিলাদের কোন রকম শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের স্বাক্ষর
নেই।
(২) দাস সমাজে
নারী
সমাজ পরিবর্তনের ঐতিহাসিক বিকাশে আদিম সাম্যবাদী সমাজের পরই আসে দাসযুগ। আদিম সমাজে কৃষিকাজ নিয়ন্ত্রণে ছিল মহিলারা। কিন্তু কৃষিতে পশু ব্যবহারের নতুন কৌশল আয়ত্বের সাথে সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
নিজের হাতে নিয়ে নেয়। মহিলারা প্রথম বারের মত উৎপাদন হতে
বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং নারী নির্যাতনের প্রথম অধ্যায় শুরু হয়। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বিলুপ্তি নারী জাতির জন্য সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক পরাজয়,
পুরুষরা গৃহস্থলির দখলও ছিনিয়ে নেয়। মেয়েদের মর্যাদার হানি হয়। তারা পুরুষের কামনার দাস ও সন্তান উৎপাদনের
যন্ত্রে পরিণত হয়। আদিম সমাজে খাদ্য সামগ্রী সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু কৃষি সমাজে উৎপাদনের উদ্বৃত্ত সামগ্রী সঞ্চয় করার সুবিধা থাকায় সম্পত্তি বাড়ানোর স্পৃহা কাজ করে। ফলে ক্ষমতাশালী পুরুষ সম্পত্তি দখল করে ব্যক্তিমালিকানার সূত্রপাত করে এবং যৌথ মালিকানার বিলুপ্তি ঘটে। দেখা দেয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ক্ষমতা যার সম্পদ তার মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে শক্তিশালী পুরুষ যুদ্ধ করে অন্যের জমি ও সম্পদ দখল
করে নিত। যুদ্ধে পরাজিত পুরুষদের মেরে ফেলা হত এবং নারীদের
বানাতো দাসী। কিন্তু কৃষিতে যখন বেশি লোক সংখ্যার প্রয়োজন পড়লো তখন পুরুষদের মারা বন্ধ করে তাদেরকে দাস বানানো হলো। দাসদের জীবন যাপন ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। বিলাস আর স্বাচ্ছন্দের সব
অধিকার ছিল স্বাধীন নাগরিকদের। দাসরা খাটবে শুধু, দাসত্ব ব্যবস্থা প্রকৃতির নিয়ম। সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানার ফলে উত্তরাধিকার নির্ণয়ের জন্য জোড় বাধা বিয়ের সূত্রপাত। উত্তরাধিকার নিয়মে মহিলাদের সম্পত্তিতে কোন অধিকার ছিল না। শুধু পুত্র সন্তান উত্তরাধিকারী ছিল। দাস সমাজে মেয়েদের অবস্থান ছিল মর্মান্তিক। এ প্রসঙ্গে, গ্রীসের
তৎকালীন চিন্তাবিদ বাগ্মী পুরুষ ডেমিস্থিনিস বলেছেন, আমরা রক্ষিতাদের রেখেছি আমাদের কামনা চরিতার্থ করার জন্য, মনোরঞ্জনকারীনীদের আমাদের সংগ দিতে এবং স্ত্রীদের রেখেছি বৈধ সন্তান উৎপাদন করতে ও বিশ্বস্ত গৃহিনী
হতে।
দাসযুগে শুধু দাসীরাই নয়- বনিক, কারিগর বা অভিজাতদের স্ত্রীরাও
প্রকৃত অর্থে দাসীর মত জীবন যাপন
করতো। ক্রিটের রাজকুমারী এরোন একটি ছেলেকে ভালবেসেছিলেন বলে তার বাবা দায়িত্বশীল গ্রীক পুরুষ হিসেবে তাকে ছোট দোদুল্যমান একটি ভেলায় করে মধ্য সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে রাজকুমারীকে মারার ব্যবস্থ করেছিলেন।
সামাজিক পরিবর্তনের ক্রমবিকাশের ধারায় দেখা যায় দাস যুগেই প্রথম পতিতালয় স্থাপিত হয়। যেখানে অভিজাত শ্রেণীর পুরুষদের অবাধ যাতায়াত ছিল। কিন্তু স্ত্রীদের আভিজাত্যের অযুহাতে গৃহে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। দাসযুগে সম্পত্তির ব্যাপারে যেমন ছিল ক্ষমতা যার সম্পদ তার, তেমনি মেয়েদের অবস্থানও ছিল যখন যার তখন তারই।
(৩) সামন্ত যুগে
নারী
সর্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের ফলে কৃষির পুনর্বিন্যাস ছাড়া ভূ-স্বামীদের টিকে
থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কৃষি খামারে শস্য উৎপাদন লাভজনক না হওয়ায় ক্রীতদাসদের
ভরণ-পোষন ভূ-স্বামীদের পক্ষে
বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। দাস সমাজ ভেঙে তার স্থলে সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে। দাসরাই সামন্ত সমাজে পরিণত ভূমিদাসে। ভূমিদাসরা সারাবছর সামন্ত প্রভূর জমিতে হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিত। বিনিময়ে ভূমিদাসকে সামান্য জমি প্রদান করা হত। পরে প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ভূমিদাসরা জমির মালিকানা পায়। কিন্তু জমির পরিবর্তে সামন্ত প্রভূকে মোটা অংকের খাজনা দিতে না পারলে কৃষকদের
উপর চালাতো নির্মম অত্যাচার।
এ সমাজে নারীর
অবস্থান দাস সমাজের চেয়েও নীচে। এ যুগেই সামাজিক,
ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে
নারী নিপীড়নের নতুন নতুন ফতোয়া জারী করা হয়। যেমন- বাল্য বিয়ে, সতীদাহ প্রথা, পর্দা প্রথা ইত্যাদি। নারীকে করা হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং
এ যুগে মহিলারা সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগই পায়নি।
সামন্ত সমাজে জমিজমা ও সম্পত্তি ছাড়াও
কৃষকের স্ত্রী, কন্যার উপর ও সামন্ত প্রভূর
অধিকার ছিল। কৃষকের ঘরে সুন্দরী স্ত্রী বা কন্যার খোঁজ
পেলেই সামন্ত প্রভূর লোলুপ দৃষ্টি সেখানে পোঁছাতো। এ জুলুমের প্রতিবাদ
করার সাধ্য কৃষকের ছিল না।
সামন্ত প্রভূর ঘরের নারীর অবস্থানও ছিল অন্য আট দশটা আসবাবপত্রের
মত। রক্ত মাংসের শরীর সম্বলিত কোন মানুষ হিসেবে নয়। সামন্ত সমাজের মতাদর্শ ছিল সৃষ্টিকর্তার সেবা করার জন্য পুরুষ আর পুরুষের সেবা
করার জন্য নারী। অর্থাৎ নারীর সম্পূর্ণ অস্তিত্ব আবর্তিত হবে বা হতো পুরুষের
স্থূল সুখকে কেন্দ্র করে।
(৪) পুঁজিবাদী যুগে
নারী
১৭৬২ সালে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব অভিযানে সামন্ত সমাজের বিলুপ্তি হয়। এবং পুঁজিবাদী সমাজের উদ্ভব ঘটে। কৃষি নির্ভর ভূমিদাসরা শ্রমিক হিসেবে কল-কারাখানায় চাকুরী
নেয়। পুঁজিবাদী সমাজ হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়ে তোলার ও ব্যবসা দ্বারা
অবাধ মুনাফা লাভের স্বাধীনতা থাকে। এ সমাজ ব্যবস্থায়
পুঁজিপতির নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে।
এ সমাজ ব্যবস্থায়
নারী উৎপাদনে সরাসরি অংশগ্রহণ করছে, বিশেষ করে কৃষি নির্ভর পরিবার ও সমাজের উৎপাদন
প্রক্রিয়ায় মহিলাদের অংশগ্রহণ পুরুষদের চেয়ে কম নয়। কিন্তু
নারীকে অনুৎপাদনশীল ও পরজীবি হিসেবে
বিবেচনা করা হচ্ছে।
এ সমাজে নারী
ঘরে বাইরে দুদিকেই শ্রম দিচ্ছে, কিন্তু বাইরে শ্রম দিতে গিয়ে হচ্ছে শ্রেণী শোষনের শিকার। অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজে নারী দ্বৈত শোষনের শিকার। বাইরে ন্যায্য মজুরী, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ
সুবিধার ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব ও নীতি প্রদর্শিত
হচ্ছে। ঘরে গৃহস্থলির কাজেও পুরুষ মোটেই নারীকে সহযোগিতা করছে না। নারী, পুরুষের কাজের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে কিন্তু এ কাজের স্বীকৃতি
নেই, কোন অর্থনৈতিক মূল্য নেই। মহিলাদের যে সব কাজের
অর্থনৈতিক মূল্য নিরূপিত হচ্ছে মহিলারা কাজের বিনিময়ে যে অর্থ পাচ্ছে
সে অর্থ ব্যায়িত হচ্ছে তার অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণে। উপার্জিত অর্থ স্বাধীনভাবে ব্যয় করার কোন অধিকার নারীর নেই।
পুঁজিবাদী সমাজে নারী সমাজ পুঁজিপতি হতে পারেনি। সারা বিশ্বের সম্পদের মাত্র এক শতাংশেরর কম
সম্পদ নারীদের দখলে। স্ত্রী স্বামীর অন্যতম একটা সম্পত্তি নিজের রক্ষনাবেক্ষণ ও সম্ভোগের জন্য
স্ত্রীকে সে যথেচ্ছা ব্যবহার
করতে পারে। শ্রমিক ও মনিবের সম্পর্কের
চেয়েও বিবাহিত নর-নারীর সম্পর্ক
বেশি ব্যাপক ও বাধ্যবাধকতাপূর্ণ। কর্মজীবন ছাড়া
ব্যক্তিগত ও যৌনজীবন পর্যন্ত
এ সম্পর্কের পরিধি বিস্তৃত। মেয়েদের শোষণ শ্রমিকদের চেয়েও ব্যাপক। এ সমাজ ব্যবস্থা
মেয়েদেরকে তার যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ দিচ্ছে না।
তাই বর্তমান যুগে নারীর ভূমিকার উন্নয়নে
নারীদের যথাযথ সুযোগ প্রদান করতে হবে এবং সুযোগ কাজে লাগাবার জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ
তৈরি করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন