Development Worker

test

All Posts

Post Top Ad

Your Ad Spot

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২১

হলুদ সাংবাদিকতা ও আধুনিক গণমাধ্যম



আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য আর দশটি সাধারণ পণ্যেরতই সংবাদও একটি পণ্য  সংবাদকে জনপ্রিয় পণ্যে পরিণত করার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হলুদ সাংবাদিকতা। সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশনই হলো হলুদ সাংবাদিকতা। সংবাদকে পণ্যকরনের নেপথ্যের দুই মহারথী জেসেফ পুলিৎজার ও  উইলিয়াম র‌্যান্ডলফ হার্জড তাদের পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য ভিত্তিহীন অর্ধসত্য নানা ধরনের মনগড়া খবর ছাপানোর এক অসুস্থ্য  প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।  তাদের এই প্রতিযোগিতারই ফষল হলুদ সাংবাদিকতা।  

 

 অন্যান্য পণ্যের মতোই সংবাদপত্রবেশকিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকের রূপ নিয়েছে। উনিশ শতকে আমেরিকায় শুরু হওয়া এই বিপ্লবের নেপথ্যে ছিল সংবাদপত্র ইতিহাসের দুই অবিসংবাদিত নেতার দ্বৈরথ। হাংগেরি থেকে অভিবাসি হয়ে আমেরিকায় আসা জেসেফ পুলিৎজারের শৈশব কেটেছে অত্যন্ত দ্বীনতায়। কিশোর বয়েসে রাস্তায় রাস্তায় পত্রিকা বিক্রিকরা আর মানুষের দুঃখ দুর্দশাকে কাছ থেকে দেখা  লিৎজার এর স্বপ্ন ছিল নিজের একটি পত্রিকা বের করার। সেখানে তিনি দরিদ্র মানুষের সংগ্রামের কথা লিখবেন এই ছিল তার সংকল্প। সেন্ট লুইস পত্রিকায় পুলিৎজার প্রথম সাংবাদিকতার সুযোগ পান। সঠিক তথ্য যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমে সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষ ও রাজনীতিকদের দুর্নীতি প্রকাশ করে পুলিৎজার অল্পদিনেই সংবাদপত্র জগতে পরিচিতি পেয়ে যান।এরপর খুব দ্রুত সেন্ট লুইস পোস্ট ডিসপ্যাচ নামের একটি পত্রিকার মালিক হন তিনি।

 

 ১৮৮৩ সালে পুলিৎজার সংবাদপত্রের জন্য বিখ্যাত নগরী নিউইয়ার্ক সিটিতে পাড়ি জমান এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড নামের একটি পত্রিকা কিনেনেন। সে সময় নিউইয়ার্কে প্রচুর অভিবাসী এসে বেকারত্ব ও দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছিল। একই অবস্থা থেকে উঠে আসা পুলিৎজার চাচ্ছিলেন এই অভিবাসী শ্রমজীবীদের জীবনের খবর প্রকাশ করে তিনি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন । সে সময় সংবাদপত্রে শুধু সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষের খবর ছাপা হতো। বেশিরভাগ পত্রিকাই ছিল রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত । তখনকার সংবাদপত্রগুলো ছিল খুবই বিরক্তিকর কারণ তৎকালীন সংবাদপত্রের সংবাদের শিরোনাম থাকতো না। সকল সংবাদ একই রকম সাইজের হরফে ছাপা হতো। পুলিৎজার তার পত্রিকায় সর্বপ্রথম হেডলাইন, নতুন হারফ, বোল্ড  টাইপোগ্রাফি ইত্যাদির প্রবর্তন করেন । এর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পুলিৎজারের পত্রিকা নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এর গ্রাহক তিনগুণ বেড়ে গিয়ে ৪৫ হাজারে পৌছায় এবং দেড় বছরের মাথায় এক লক্ষ গ্রাহক তার পত্রিকা পড়তে শুরু করে। পুলিৎজারের দৃঢ়-সংকল্প আর সাহসী পদক্ষেপ তাকে নিউইয়র্ক এর অন্যতম প্রভাবশালী মানুষের পরিণত করে।

 

                                                                  চিত্র-  পুলিৎজার 

 নিউইয়র্ক থেকে ২০০ মাইল দূরে ম্যাসাচুসেটস এর কেমব্রিজে বসে পুলিৎজার’র এই উৎথান সুক্ষ্য  দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন উইলিয়াম র‌্যান্ডলফ হার্জড । ধনী পরিবারের প্রাচুর্য বেড়ে ওঠার হার্জড ছোটবেলা থেকেই ছিলেন উচ্চাভিলাষী সংবাদপত্র ব্যবসায় আগ্রহী হার্জড ১৮৮৭ সালে তার পিতার মালিকানাধীন পত্রিকা সানফ্রান্সিসকো এক্সামিনারের দায়িত্ব নেন। নিম্নমানের খবরের জন্য পত্রিকাটির ছিল খুবই খারাপ অবস্থা। পুলিৎজারের কৌশল অবলম্বন করে হার্জড তার পত্রিকাকে নতুন রূপদেন। তিনি তার পত্রিকায় মিথ্যা ভুয়া তথ্য দিয়ে মুখরোচক খবর ছাপাতে থাকেন যা বর্তমান সময়ে হলুদ সাংবাদিকতা হিসেবে পরিচিত।

 

সানফ্রান্সিসকো এক্সামিনার অল্প কিছু দিনেই গ্রাহক প্রিয়তা লাভ করে। এরপর হার্জড নিউইয়ার্কে আসেন তাঁর আদর্শ গুরুর পুলিৎজার এর সাথে প্রতিযোগিতা করতে। পুলিৎজার ও হার্জড এর মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল, পুলিশের ক্ষমতার প্রতি আগ্রহী ছিলেন একটি বিশেষ পরিবর্তনের লক্ষ্যে। তিনি চেয়েছেন সমাজের খেটে খাওয়া মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে অন্যদিকে হার্জড এর ক্ষমতার প্রতি আগ্রহ ছিল শুধুমাত্র আত্মউন্নয়ন এবং নিজেকে প্রভাবশালী করার লক্ষ্যে।

 

হার্জড নিউইয়র্কে এসে নিউইয়র্ক মর্নিং জার্নাল নামের একটি সংস্থা পত্রিকা কিনে ঠিক সেই সময়ে পুলিৎজার নিউইয়ার্কের বাইরে অবস্থান করায় সুযোগসন্ধানী হার্জড মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পুলিৎজারের পত্রিকার সেরা কর্মীদেরকে নিজের পত্রিকায় নিয়ে আসেন এবং তার প্রত্রিকার নতুন নাম হয় নিউইয়ার্ক জার্নাল।

 

                                                           

                                                                         চিত্র- নিউইয়র্ক জার্নাল


হার্জড নিউইয়র্কে এসে নিউইয়র্ক মর্নিং জার্নাল নামের একটি সস্তা পত্রিকা কিনে নেয়।  ঠিক সেই সময়ে পুলিৎজার নিউইয়ার্কের বাইরে অবস্থান করায় সুযোগসন্ধানী হার্জড  মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পুলিৎজারের পত্রিকার সেরা কর্মীদেরকে নিজের পত্রিকায় নিয়ে আসেন - আর তার পত্রিকার নতুন নাম হয় নিউইয়র্ক জার্নাল। উইলিয়াম হার্জড এর পত্রিকার প্রথম পাতার হেডলাইনগুলো ছিলো অপরাধ ও স্কান্ডেল জাতীয় সংবাদে ভরপুর এর ফলে মাত্র তিনমাতে হার্জড এর পত্রিকা দ্বীগুণ গ্রাহক অর্জন করে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হার্জড তার পত্রিকার দামও কমিয়েদেন। পুলিৎজারের আট পৃষ্ঠার পত্রিকা নিউইয়ার্ক ওয়াল্ডের বিক্রয় মূল্য ছিলো দুই সেন্ট অন্যদিকে হার্ডজ তার ষোল পৃষ্ঠার নিউইয়ার্ক জার্নাল বিক্রি করতো এক সেন্টে । এরফলে পুলিৎজার তার পত্রিকার গ্রাহক হারাতে শুরু করে। পুলিৎজার হার্জডের ধূর্ততায় মানসিকভাবে অত্যন্ত আহত হন। হার্জডের নিত্যনতুন কৌশলের কাছে বার বার ধরাসাই হতে থাকেন পুলিৎজার ও তার পত্রিকা। সাংবাদিকেরা সে সময় তারকাদের সমপর্যায়ের ছিলেন এই তারোকারা পত্রিকার পাতায় কি লিখছেন তা জানার জন্যই অগ্রহী পাঠকেরা নিয়মিত সংবাদপত্র কিনতো। পুলৎজারের পত্রিকায় কাজকরা সেসময়ের অন্যতম সেরা সাংবাদিক ছিলেন আর্থার ব্রিজবেন। সেসময়ের রিচার্ড ফেন্টো নামের একজন কার্টুনিস্ট পুলিৎজারের নিউইয়ার্ক ওয়াল্ডের প্রথম পাতায় ইয়োলো কিড বা হলুদ বালক নামের একটি কার্টুন আকতেন। এই কার্টুনের মাধ্যমে পুলিৎজার সামাজিক অসংগতি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বলিয়ে নিতেন যা ছিলো অনেকটাই পক্ষপাতদুষ্ট । পুলিৎজারের পত্রিকার এই দুই তারোকা সাংবাদিককে হার্জড অধিক বেতনের প্রলোভনে তার নিজের পত্রিকায় নিয়ে আসেন। তখন পুলিৎজার বাধ্য হয়ে জর্জ লুকাস নামের আরেক কার্টুনিস্টকে নিয়োগদেন। এরপর থেকে উভয় পত্রিকায় ছাপা হতে লাগলো ইয়োলো কির্ডজ কার্টুন। শুরু হয়েগেলো পত্রিকার কাটতি নিয়ে দুটো পত্রিকার মধ্যে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব। এই ইয়োলো কির্ডজ কার্টুনের মাধ্যমে ছাপানো ভিত্তিহীন, অর্ধসত্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ তখন থেকেই ইয়োলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।

 

                                                                        চিত্র-   উইলিয়াম হার্জড 


এরফলে তৈরিহয় নষ্ট মানসিকতা সম্পন্ন এক পাঠক শ্রেণী যারা সবসময় চটকদার ভিত্তিহীন চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী অর্ধসত্য সংবাদ প্রত্যাশা করতো এবং সেসব সংবাদ পাঠকরে তারা তৃপ্তিপেত। ১৮৯৮ সালের ১৫ই ফ্রেব্রুয়ারী কিউবার হাভানায় নোঙ্গরফেলা একটি ইউএস মেরিন জাহাজে আকস্মিক বিস্ফরণে প্রায় ২৫০ জন আমেরিকান নাবিক মারা যান। হার্জড এই দুর্ঘটনাকে স্পেনের স্মরযন্ত্র আখ্যাদিয়ে ভুয়া তথ্যের সাহেয্যে পত্রিকা খবর প্রকাশ করে। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৯৮ সালের ২৫ এপ্রিল চাঞ্চল্যকর সেই ভুয়া সংবাদ প্রকাশের দুইমাসের মাথায় আমেরিকান কংরেস স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখান বাজরে টিকেথাকার লড়ায়ে পুলিৎজারও হার্জড এরমতো ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে। স্প্যানিশ আমেরিকান যুদ্ধ তাদের উভয়ের জন্যই পত্রিকা বিক্রির একটি লাভজনক বাজার সৃষ্টি করেছিলো। এযুদ্ধের সময়ই হার্জড এর পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক সংখ্যা দশ লক্ষ্য ছাড়িয়ে যায়।

 

তৎকালীন সময়ে দৈনিক পত্রিকা গ্রাহকের কাছে পৌছেদিত পথশিশুরা তাদের নিউজি নামে ডাকা হতো। যুদ্ধকালীন সময়ে নিউজিরা একশোটি পত্রিকা কিনতো পঞ্চাশ সেন্ট মূল্যে। স্প্যানিশ আমেরিকান যুদ্ধের পর পুলিৎজার ও হার্জড একত্রিত হয়ে অধিক মুনাফার জন্য কঠর অবস্থানে যান। সে  সময়ে অবিক্রিত পত্রিকার মূল্যফেরত ব্যবস্থা বাতিলকরাসহ নিউজিদের কাছে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ষাইট (৬০) সেন্ট। এর প্রতিবাদে নিউইয়ার্কের পথশিশুরা দুই ক্ষমতাধর পত্রিকা বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে পত্রিকা দুটির বিলি ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে য়ায়। দুই পত্রিকার ব্যবসা তাদের মালিকের নিষ্টুরতার জন্য আচমকা হুমকির মুখে পড়েযায়। একপর্যায়ে পুলিৎজার তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন। কারণ তিনি নিজেও একসময়ে নিউজি ছিলেন। অবশেষে দুজনেই নিউজিদের অবিক্রিত পত্রিকার টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো ১৮৯৯ সালের ২আগষ্ট ধর্মঘট শেষ হয়।

                                                                             চিত্র- নিউজি


সততার সাথে সংবাদ প্রকাশ করে সুখ্যাতি লাভকরা পুলিৎজার অর্থ উপার্জনের মোহে র‌্যান্ডলফ হার্জড এর সাতে জঘন্য এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। পরবর্তিতে পুলিৎজার তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই মিলিয়ন ডলার দান করেন। এখানেই সর্বপ্রথম সাংবাদিকতা বিষয়ক শিক্ষাদান শুরু হয়। পরবর্তিতে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের একটি প্রধান ক্ষেত্রে তৈরি হয় কলাম্বিয়া স্কুল অব জার্নালিজম।

 

১৯১১ সালের ২৯ অক্টোবর পুলিৎজারের মৃত্যুর পরথেকে তার সম্মানে পুলিৎজার পুরস্কার প্রবর্তন করা হয় । অপরদিকে র‌্যান্ডলফ হার্জড রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন এবং এক সময়ে হলিউডে প্রতিষ্ঠীত হন। এই দুই মহারথির লড়ায়ের মাঝে সংবাদপত্র শিল্পের বিপ্লব সাধিত হয়। আজকে আমরা যে আধুনিক গণমাধ্যম ব্যবস্থা দেখছি এই রূপরেখার অনেকটাই গড়ে উঠেছে পুলিৎজার ও হার্জড এর দ্বৈরথের মধ্য দিয়ে।

 

 

 

 

   

 

 

Post Top Ad

Your Ad Spot

Pages