Development Worker

test

All Posts

Post Top Ad

Your Ad Spot

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

রাজশাহীর দুঃখ ফারাক্কা


                                                                         চিত্র- ফারাক্কা বাঁধ 



বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। ১৯৬১ সালে গঙ্গা নদীর উপর এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং নির্মাণ সম্পন্ন হয়  ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে। বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২.২৪ কিলোমিটার এটি শুধুমাত্র একটি বাঁধই নয় এই অবকাঠামোটি সড়ক ও রেল যোগাযোগ সেতু হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বাঁধটিতে মোট ১০৯ টি গেট  রয়েছে। ফারাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে এই বাঁধ থেকেই জল সরবরাহ করা হয়। ১৯৫০ ও  ৬০ এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীর পলি ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয় যা হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কম্পানি প্রায়বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায়  নির্মাণ করে।

 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বন্টন বিষয়ে আলোচনা করেন।  এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না যদিও বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে মাত্র দশ দিনের জন্য ভারতকে গঙ্গা নদীর ৩১০ থেকে ৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু ভারত ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা নদী থেকে ১১৩০ কিউসেক পানি অপসারণ করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে। বাংলাদেশের সাথে করা ভারতের  ধরনের অন্যায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচনা করা হলেও বিষয়টি ভারত খুব একটা পরোয়া করেনি।

 

 এর পর ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৫ ১৯৯২ সালে  স্বল্প মেয়াদী পানি বন্টন চুক্তি হলেও কোনবারই ভারত তার কথা মত কাজ করেনি। এরপর ১৯৯৬ সালে হওয়া ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার চুক্তিতে পানি বন্টনের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা থাকলেও তাও ঠিক মতো মানছেনা ভারত।  প্রতিটি চুক্তির পর ভারত অন্যায় ভাবে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে।  

নদীর বা প্রবাহমান কোন জলরাশির পানি পরিমাপের একক হল কিউবিক ফিট পার সেকেন্ড যাকে সংক্ষেপে বলা হয় কিউসেক। ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক আর ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি পানি থাকলে ৪০ হাজার কিউসেক  পাবে ভারত আর বাকিটা পাবে বাংলাদেশ অথচ ভারতের খেয়ালখুশিমতো বাঁধ থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পানি অপসারণ ও বন্ধের ফলে শুষ্ক মৌসুমে তীব্র খরা ও বর্ষা মৌসুমে প্রচন্ড বন্যার কবলে পড়ছে বাংলাদেশ।  ফারাক্কাবাঁধ কেন্দ্রিক এই স্বেচ্ছাচারিতার ফলে শুধু বাংলাদেশ নয় ভারত নিজেও  মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে।

 

ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে দুই দেশের নদী বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধিতা করে বলেন গঙ্গা-পদ্মার মত বিশাল নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।  এরপরও ভারত সরকার গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণ এবং হুগলি ভাগীরথী নদীতে পানি পৌঁছানোর জন্য ফিডার খাল খননের কাজ শুরু করে। এইবাঁধ থেকে ভাগীরথী হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য প্রায়   ৪০ কিলোমিটার।  এই অপরিণামদর্শী প্রকল্প বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে।  ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের পদ্মা পরিণত হয়েছে একখণ্ড মরুভূমিতে। বাঁধের ফলে পদ্মা নাব্যতা হারিয়েছে আড়াই হাড়ার কিলোমিটার নদীপথ সেই সাথে ৪৯টি শাখা নদীর অস্থিত্ব সম্পুর্ণ বিলিন হয়েছে। ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর পর গত চার দশকে গঙ্গা অববাহিকায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। গঙ্গার উজানে বিহার ও উত্তর প্রদেশ এবং ভাটিতে সুন্দরবন পর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয়ের চিত্র আজ সুস্পষ্ট । গঙ্গার উজানে বিপুল পরিমাণ পলিজমে প্রতি বছর বন্যা দেখা দিচ্ছে ভারতের বিহারসহ উত্তর প্রদেশের বিস্তৃর্ণ এলাকায়। অন্যদিকে গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির আটকে রাখার ফলে নদীর স্বভাবিক গতি হারিয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে ভাটি অঞ্চলের বাংলাদেশ। ফারাক্কা বাঁধের ফলে প্রতিবছর বিহারেই ২০ লাক্ষ মানুষ হুমকির মুখে পড়ছে।

বাংলাদেশে আসা গঙ্গাবাহিত পলির পরিমাণ দুই বিলিয়ন টন থেকে এক বিলিয়ন টনে নেমে এসেছে । এরফলে মেঘনা মোহনায় অবস্থিত চরাঞ্চলের গঠনপ্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের উপকূলিয় অঞ্চলের ভূমি গঠন ও ভূমি পুনঃরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিপর্যস্থ  হয়ে যাবে। এই বাঁধের কারণে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মার এখন মূমর্ষ অবস্থা । এই অঞ্চলের সবুজ শ্যামল বাংলা হয়তো অচিরেই মরুভূমিতে পরিণত হবে।


                                                                        চিত্র- মরুকরন-১



শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস, শিল্প, নৌপরিবহন, পানি সরবারহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসান হচ্ছে। অর্থিকমূল্যে প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় তিনশোকোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়।

 

পদ্মার পানি প্রবাহ মারাত্নকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অববাহিকায় রাজশাহী , চাপাইনবাবগঞ্জ এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ৮-১০ ফুটের জায়গায় ১৫ ফুট নিচে নেমেগেছে। মৌসুমী বৃষ্টি এই স্তরের পানির অভাব পূরণ করতে পারছেনা ।  পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে মাটির আদ্রতা কমেগেছে ৩৫ শতাংশ, অদ্রতার অভাবে দিনের নিম্নতম ও উচ্চতম তাপমাত্রা তারতম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমেগেছে ফলে প্রতিবছর প্রায়ই বড়মাপের বন্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এছাড়া মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয় কৃষিক্ষেত্রে এর ভয়াবহ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাঁধের ফলে খুলনা অঞ্চলের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির অদ্রতা হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও মিঠা পানির অপ্রাপ্যতার জন্য মৎস সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে । গঙ্গার অনিয়ন্ত্রীত পানি প্রবাহের কারণে এই অঞ্চলের প্রায় দুই শতাধিক মাছের প্রজাতি ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ী হুমকির সম্মুখীন। মাছের সরবারহ কমে যাওয়ার ফলে কয়েকহাজর জেলে বেকার হয়েপড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ নৌচলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

 


                                                                   চিত্র- নাব্যতা হারানো ও মরুকরন


সম্প্রতি ভারতেও  ফারাক্কার বিরুদ্ধে জনমত জোরালো হচ্ছে কারণ ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে।  যে কোলকাতা বন্দর টিকিয়ে রাখতে এই বাঁধ দেওয়া হয়েছিল বাঁধ নির্মাণের ৪৩ বছর পরও কোলকাতা বন্দরকে  বাঁচানো যায়নি এমনকি কলকাতা বন্দর সচল রাখতে বর্তমানে যে পরিমাণ ড্রেজিং করতে হয় ফারাক্কা বাঁধ চালু করার আগেও এতটা করতে হতো না। বাঁধ নির্মাণের আগে স্থানীয় অধিবাসীদের বলা হয়েছিল ফারাক্কা চালু হলে আর বন্যা হবে না কিন্তু অতীতের তুলনায় ভয়াবহ বন্যা দেখা গেছে শুধুমাত্র বাঁধের কারণে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থামাতে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ফারাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছেন কিন্তু বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন কর্মীরা বলছেন বাঁধটি না  ভেঙে এর সড়ক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখেই বাঁধের গেট গুলো অপসারণ করা সম্ভব। নদীতে এ ধরনের বাঁধের ফলে যদি লাভের চেয়ে লোকসানই হয় সে ক্ষেত্রে তা তুলে ফেলার একাধিক নজির ইউরোপ-আমেরিকায়ও রয়েছে।


 তাই বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের জন্য অভিশাপ স্বরূপ এই ফারাক্কা বাঁধ অবিলম্বে সরিয়ে ফেলাই হবে সকলের জন্য মঙ্গলকর

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

Post Top Ad

Your Ad Spot

Pages